তথ্যের আলোকে নভেল করোনা ভাইরাস ও COVID-১৯


করোনা ভাইরাস নিয়ে আপনার মনে অনেক ধন্দ রয়েছে? দেখুন তো, এখানে তার কিছু সুরাহা হয় কিনা।

করোনা ভাইরাস কি?

গঠনগতভাবে করোনা ভাইরাস একটা বিশাল আরএনএ (RNA) ভাইরাসের পরিবার। “করোনা” শব্দটার আক্ষরিক অর্থ হলো মুকুট। ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের তলায় এই পরিবারের ভাইরাসকে অনেকটা রাজার মাথার মুকুটের মতন দেখায়, সেই থেকে এই নামকরণ (ছবি ১ দেখুন)। অন্যসকল ভাইরাসের মতো এরাও জীবনধারণ ও বংশবৃদ্ধির জন্য কোন না কোন একটা প্রাণী বা উদ্ভিদ কোষের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকে।

এই ভাইরাসের সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের স্পাইক বা কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হলো রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। জীবন্ত কোষের ভিতরে প্রবেশ করে ভাইরাসটা  আরএনএ-র প্রতিলিপি তৈরি করে বংশ বিস্তার করে। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা ভাইরাসের অন্যান্য অংশকে ধরে রাখে। করোনাভাইরাস-এর মারাত্মক প্রকোপ এবং এবং তাকে কিকরে ঠেকিয়ে রাখা যায়, সেটা বুঝতে হলে এই তিনটে অংশের কথাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

ছবি ১ –  করোনা ভাইরাস-এর গঠন (ছবির সূত্র)

যদিও করোনাভাইরাসের অনেক প্রজাতি আছে, তার মধ্যে মাত্র সাতটা প্রজাতি মানুষের দেহে রোগ সংক্রমণ করতে পারে [১]।  এদের মধ্যে চারটে সারা বছর ধরে অত্যন্ত সাধারণ হাঁচি-কাশি সর্দির উপসর্গ সৃষ্টি করে। এরা হল, 229E (আলফা করোনাভাইরাস)NL63 (আলফা করোনাভাইরাস)OC43 (বিটা করোনাভাইরাস)HKU1 (বিটা করোনাভাইরাস)

এছাড়া, মার্স কভ (MERS-CoV) – এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা থেকে ২০১২ সালে মিড্ল্ ইস্ট রেস্পিরেটারি সিন্ড্রোম বা মার্স (Middle East Respiratory Syndrome, or MERS) ছড়িয়েছিল। সার্স কভ (SARS-CoV)– এটা একটা বিটা করোনাভাইরাস যা অতি তীব্র শ্বাস রোগ  বা সার্স (severe acute respiratory syndrome, or SARS) ছড়িয়েছিল। প্রথম ২০০২ সালে চীন দেশে এই রোগ দেখা গিয়েছিল।  মৃত্যুর হার প্রায় ১০০ রোগীপিছু ১০, তবুও এই রোগকে দ্রুত বাগে আনা গেছিলো কারণ মানুষ থেকে মানুষে তার সংক্রমণের হার ছিল কম। সব মিলিয়ে মোট ৮,০০০-এর কাছাকাছি রোগী এই রোগে আক্রান্ত হয় ও প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষণায় প্রমাণ হয় যে একধরনের গন্ধগোকুল প্রজাতির প্রাণীর থেকে এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছিল।  তৃতীয় আরেকটা টাইপ, সার্স কভ-২ (SARS-CoV-2) (severe acute respiratory syndrome coronavirus 2)-কেই নভেল করোনা ভাইরাস বলা হয়। এই সার্স কভ-২ মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ সংক্রামিত করে। এই ভাইরাসকে নভেল বা নতুন বলা হচ্ছে কারণ এই সংক্রামক ভাইরাসটা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটার আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি (2019-NCOV)। মানুষ থেকে মানুষে এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর প্রায় ১৬৬টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO-র ১৮ই মার্চের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, – সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত ১,৯১,১২৭ জন (নতুন রোগী ১১,৫২৬), মৃত্যু হয়েছে ৭,৮০৭ জনের, সেরে উঠেছেন ৬৭,০০৩ জন [২]। ভারতে এখন (১৮ই মার্চ,২০২০) আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। মৃত্যু হয়েছে চারজনের। সেরে উঠেছেন উনিশজন [৩]।

ছবি ২ –  বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকারক করোনা ভাইরাস (ছবির সূত্র)

কোভিড-১৯ (COVID-19) কি?

নতুন আবিষ্কৃত বা নভেল করোনা ভাইরাসের সংস্পর্শে মানুষের দেহে যে ছোঁয়াচে রোগ সৃষ্টি হয়, সেই রোগের নাম কোভিড-১৯ (COVID-19) বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ (coronavirus disease)। ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগের প্রাদুর্ভাব হয়। ভাইরাস সংক্রমণ সব বয়েসের মানুষের মধ্যে হলেও যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা বয়স্ক, তাদের এই রোগে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি [৪]।

করোনাভাইরাস  কি তার গঠন বদলাতে পারে অর্থাৎ এর কি মিউটেশান (Mutation) হতে  পারে?

এই প্রশ্নটা জরুরি কারণ ভাইরাস-কে একটা অপরিবর্তনশীল বস্তু বলে ভাবলে চলবে না। যেকোনো আর.এন.এ (RNA) ভাইরাসের মতো সার্স কভ-২-ও খুব সহজেই তার গঠন বদলাতে পারে। অর্থাৎ, ভাইরাস যখন বংশ বিস্তার করে তখন যেমন খুশি নিজেদের জিনের সজ্জা বদলে ফেলতে পারে। এই জিনের পরিবর্তিত সজ্জা নিয়েই ভাইরাস এক মানব দেহ থেকে অন্য মানব দেহে সংক্রামিত হয়।

এখনও পর্যন্ত, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রায় ১০০বার মিউটেশান লক্ষ্য করা গেছে। বার বার মিউটেশানের ফলে ভাইরাস খুব সহজেই নতুন নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশানের প্রভাবে কোভিড-১৯ যুক্ত রোগীর উপসর্গে কি পরিবর্তন হচ্ছে তা এখনি বলা সম্ভব নয়। তাঁর জন্য প্রচুর নমুনা সংগ্রহ করে ভাইরাসের জিনোম সিকয়েন্সিং করে পরিবর্তন লক্ষ্য করতে হবে [৫]। 

কোভিড-১৯(COVID-19)-এর উপসর্গগুলি কি?

রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে।

সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। আক্রান্ত হবার পর প্রথম দিকে উপসর্গ খুবই কম থাকে, তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কখনও কখনও এর পরিণামে নিউমোনিয়া ও শেষে মাল্টি অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে (১৪%)। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির কোন উপসর্গই থাকে না বা তারা অসুস্থ বোধ করেন না।  প্রায় ৮০% আক্রান্ত মানুষই সেরকম কোন চিকিৎসা  ছাড়াই সেরে ওঠেন।

জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টা  খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। প্রতি ছ’জন আক্রান্তের মধ্যে, একজনের শ্বাসকষ্টজনিত গুরুতর অবস্থা হতে পারে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, এবং যারা বয়স্ক ( বিশেষত যাদের উচ্চ-রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা বা ডায়াবেটিস রয়েছে) তাদের এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে [৬]।

COVID-19 আটকানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের বহু দেশ দৈনন্দিন জীবনযাপন ও চলাফেরার উপর আমূল নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। কারণ হিসাবে কতগুলো কথা উঠে আসছে মিডিয়াতে, যেমন ‘এক্সপোনেন্সিয়াল’, ‘ফ্ল্যাটেন দ্য কার্ভ’, ‘স্যোশাল আইসোলেশান’ – এত সাবধানতার কী প্রয়োজন আছে? এই শব্দগুলোরই বা মানে কী?

কোভিড-১৯(COVID-19) একটা ছোঁয়াচে রোগ। নভেল করোনাভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু শরীরে ভাইরাস ঢোকা মানেই এমন নয় যে COVID-19 রোগের উপসর্গ সঙ্গে সঙ্গে ফুটতে আরম্ভ করবে। কারোর ক্ষেত্রে দিন দুয়েকের মধ্যেই উপসর্গ দেখা দেয়, কারোর ক্ষেত্রে আবার সপ্তাহ দুয়েক! এই সময়কে বিজ্ঞানের ভাষায় ইনকিউবেশান পিরিয়ড (Incubation period) বলে। এখনো পর্যন্ত দেখা গেছে নভেল করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ড গড়ে পাঁচদিনের মত। অর্থাৎ, এই ইনকিউবেশান পিরয়ডের মধ্যে সংক্রামিত কেউ না জেনেই আরও অনেককে সংক্রামিত করতে পারে। এক মাসের মধ্যে একজন কত জনকে সংক্রামিত করতে পারে? একটা সহজ অঙ্ক কষা যাক।

ধরা যাক, সমীরণ মাসের এক তারিখে করোনা ভাইরাসে সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচদিন অব্দি তার শরীরে COVID-19 এর কোন লক্ষণ ধরা পড়ে নি, কিন্তু সে অনেকের সাথে একসাথে আড্ডা দিয়েছে, একসাথে রেস্টুরান্টে খেতে গিয়েছে। আর এই মেলামেশার ফলে তার অজান্তেই দু-তিনজন সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মাসের ছ’তারিখ নাগাদ যখন তার COVID-19-এর লক্ষণ ধরা পড়ল তখন থেকে সে অন্যদের সাথে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু ততক্ষণে কয়েকজনের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছে ভাইরাস।

সমীরণ যে দু-তিনজনের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে তারাও অন্যদের সাথে মেলামেশা করেছে! ধরা যাক তাদেরও COVID-19 এর উপসর্গ ধরা পড়তে দিন পাঁচেক সময় লেগেছে। তাহলে এই দুই-তিনজনের প্রত্যেকে আরও দু-তিনজন করে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়েছে! এবার যারা আক্রান্ত হল তাদের প্রত্যেকে আরো কিছু সুস্থ মানুষের মধ্যে ভাইরাস ছড়াবে। এমন করে মোট আক্রান্তের সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়তে থাকবে। একজন আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসের ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে ধরা যাক গড়ে R0 (‘আর-নট’ বা ‘আর-জিরো’, reproduction number of the virus বোঝাতে) সংখ্যক লোককে সংক্রামিত করে। নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল প্রায় আড়াই জন (মানে গড়ে আড়াই জন, এমন নয় যে তৃতীয় ব্যক্তির শরীরের অর্ধেক সংক্রামিত হয়েছে !)। ইনকিউবেশান পিরিয়ড পাঁচদিন ধরে নিলে প্রথম পাঁচদিনের শেষে, মানে মাসের ছ’তারিখ নাগাদ গড়ে R0 জন সংক্রামিত হল। এর পরের পাঁচ দিনে এই R0-এর প্রত্যেকে আরও R0 জনকে সংক্রামিত করল। অর্থাৎ, মাসের এগারো তারিখ নাগাদ ভাইরাস আক্রান্ত লোকের সংখ্যা হল R0। নভেল করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা হল গড়ে

২.৫= ২.৫x২.৫ = ৬.২৫,

অর্থাৎ গড়ে প্রায় ছ’জন। মাসের ষোল তারিখ নাগাদ

 ২.৫ = ২.৫x২.৫x২.৫ = ১৫.৬২৫

অর্থাৎ, আরো প্রায় ষোল জন সংক্রামিত হল। এইভাবে মাসের শেষের পাঁচদিনের মধ্যে নতুন সংক্রামিত লোকের সংখ্যা হবে

 ২.৫  = ২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫x২.৫ = ২৪৪

অর্থাৎ প্রায় আড়াইশোর কাছাকাছি।  তাহলে এক মাসের মধ্যে মোট সংক্রমণের সংখ্যা হল প্রায় চারশো জনের মত!

পৃথিবীর বেশীরভাগ দেশের করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা সময়ের সাথে এইভাবে হু হু করে বাড়ছে। এই ধরণের বৃদ্ধিকে এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (exponential growth) বলে। উদাহরণস্বরূপ,  ছবি ৩-এ  সময়ের সাপেক্ষে কিছু দেশের করোনা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। বেশিরভাগই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি।

উপরের অঙ্কটা বুঝলে এটাও বোঝা যাবে কেন COVID-19 আমরা সাধারণ যে ফ্লু তে আক্রান্ত হই তার থেকে অনেক বিপজ্জনক। ফ্লু এর ক্ষেত্রে Rহল ১ এর কাছাকছি, অর্থাৎ একজন সংক্রামিত ব্যক্তি গড়ে একজনকে সংক্রামিত করে। COVID-19 ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ২.৫, তাই অনেক তাড়াতাড়ি সংক্রমণ বাড়ছে।

এই এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধির কার্ভটাকে একটু চ্যাপ্টা করা (‘flatten the curve’), অর্থাৎ বৃদ্ধির হারটা কমিয়ে দেওয়াই এখন সব দেশের উদ্দেশ্য। না হলে এত আক্রান্ত লোকের চিকিৎসা করার মত সামর্থ্য প্রায় কোন দেশেরই নেই। COVID-19-এর কোন প্রতিষেধক টীকা এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাহলে, উপায়? এখানেই স্যোশাল আইসোলেশান, অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়ার  অপরিসীম গুরুত্ব।

ছবি ৩ – বিশ্বের কয়েকটি দেশের করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যার এক্সপোনেন্সিয়াল বৃদ্ধি (১৮ মার্চ পর্যন্ত)। চীনের ক্ষেত্রে exponential curve এর flattening  লক্ষণীয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে চীনের জনগণের চলাফেরার উপর কঠোর নিষেধ জারী হয়েছিল। ছবির সূত্র – The Globe and Mail (Canada),  Johns Hopkins University

একজন ভাইরাস সংক্রামিত ব্যক্তির থেকে কতজন সংক্রামিত হবে তা নির্ভর করবে সেই ব্যক্তি (আমাদের উদাহরণে সমীরণ) ইনকিউবেশান পিরিয়ডের মধ্যে কতজনের সাথে মেলামেশা করেছে। সমীরণ ও তার থেকে ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তিরা যদি যতটা সম্ভব নিজেদের অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো, তাহলে ভাইরাসের সংক্রমণের হার কম হতো – অর্থাৎ R0 সংখ্যাটা কমে যেত। ধরা যাক, সরকারের নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদির ফলে বেশীরভাগ রেস্টুরান্ট, অফিস-কাছারী বন্ধ, তাই এখন আর গড়ে ২.৫ নয়, বরং তার অর্ধেক লোক, গড়ে ১.২৫ জন একজনের থেকে সংক্রামিত হচ্ছে। অর্থাৎ, মাসের শেষ পাঁচদিনে মোট সংক্রমণের সংখ্যা হবে

১.২৫ = ১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫x১.২৫ =  ৩.৮১৫

জনের মত! সারা মাসে মোট সংক্রমণের সংখ্যা ১ + ১.২৫ + ১.২৫ + ১.২৫ + ১.২৫ + ১.২৫ + ১.২৫ = ১৫ জনের মত। আগে এই সংখ্যাটাই ছিল প্রায় চারশো, সেখান থেকে নেমে মাত্র পনেরো জনে এসে ঠেকেছে।

এই ধরণের ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে তাই আমাদের সামাজিক কর্তব্য হলো নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া, যাতে ভাইরাস একজনের থেকে অনায়াসে অন্যজনের কাছে না পৌঁছতে পারে। এই দূরত্ব ততদিন বজায় রাখতে হবে, যতদিন না অবধি পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে, টীকার বা চিকিৎসার সাহায্যে, বা অন্যান্য কোন প্রাকৃতিক কারণে ভাইরাসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে।

আপাতত করোনা ভাইরাসের মহামারীকে ঠেকানোর একমাত্র উপায় হ’ল, এর ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেওয়া ও শেষ পর্যন্ত থামিয়ে দেওয়া।

শরীর খারাপ হলেই কি  করোনা ভাইরাসের-এর জন্য পরীক্ষা করা জরুরি ?     

আগেই বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগের উপসর্গ মূলতঃ জ্বর, শুকনো কাশি, ক্লান্তি। এছাড়া সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, গলাব্যাথা, ডায়েরিয়া-ও হতে পারে। সাধারণ ফ্লু বা সর্দিজ্বরের সঙ্গে এর অনেক মিল পাওয়া যায়। তাই এই উপসর্গগুলো থাকলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিশ্চিত হওয়া উচিৎ যে রোগীর করোনা ভাইরাসের পরীক্ষা  করা প্রয়োজন কিনা। তবে পরীক্ষাগারের সংখ্যা যেহেতু সীমিত, এইসকল উপসর্গযুক্ত যেকোনো রোগীর-ই অযথা পরীক্ষার সংখ্যা কমানো উচিৎ। আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যদিও এই রোগের নির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই (এই প্রতিবেদনটা  লেখার দিন পর্যন্ত), তার মানে এই নয় যে পরীক্ষা করা অর্থহীন। পরীক্ষায় রোগ আছে  প্রমাণিত হ’লে রোগীকে আলাদা করে রাখা যায় যাতে তার থেকে ভাইরাস অন্য সুস্থ মানুষের দেহে সংক্রামিত না হয়। এছাড়াও পরীক্ষা হলে তবে কোন দেশে  কত আক্রান্তের সংখ্যা তার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া সম্ভব। আর তবেই ভাইরাসের প্রকৃতি ও ছড়িয়ে পড়ার গতি নির্ণয় করা যায়। বর্তমানে ভারতে ৫২টি ল্যাবরেটারীতে এই পরীক্ষা করা হচ্ছে [৭]।

ছবি ৪ – ভারতের ৫২টি করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কেন্দ্রের নাম

করোনা ভাইরাস-এর পরীক্ষা কিভাবে করা হয় ? 

বস্তুত যেকোনো জায়গাতেই এই পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা সম্ভব। সাধারণতঃ রোগীর গলার ভিতরে একটি তুলোর ডেলা (cotton swab) প্রবেশ করিয়ে, সেটার সাহায্যে লালা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়। এছাড়া র‍্যাপিড টেস্টে আন্টিবডির উপস্থিতি লক্ষ্য করার জন্য রক্ত পরীক্ষাও করা যেতে পারে। তবে সম্ভবতঃ শুধুমাত্র চীনেই সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।

নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়াটা সহজ হলেও ল্যাবরেটারীতে তা পরীক্ষা করার পদ্ধতিটা বেশ জটিল। নমুনাটা দিয়ে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (Reverse Transcriptase Polymerase Chain Reaction) করা হয়। যেকোনো পলিমারেজ চেন রিয়েকশান (PCR)  কোষের ডিএনএ-তে (DNA) ঘটে।  কিন্তু, যেহেতু করোনা ভাইরাস একটা আরএনএ (RNA) ভাইরাস, তাই পরীক্ষাটার প্রথম ধাপে রোগীর দেহ থেকে প্রাপ্ত নমুনায় ভাইরাস থাকলে তার আরএনএ প্রথমে DNA-তে রূপান্তরিত হয়। তারপর PCR পদ্ধতিতে DNA-র  অগুন্তিবার রেপ্লিকেশান ঘটে যে প্রতিলিপি তৈরি হয়, তা থেকে নমুনাতে ভাইরাসের উপস্থিতি সহজেই বোঝা যায়। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে  করোনা  পসিটিভ বলা হয়। আর ভাইরাস না থাকলে কোন প্রতিলিপিই তৈরি হয় না। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে  করোনা  নেগেটিভ বলা হয়। ২৪ ঘন্টা লাগে টেস্টের রেসাল্ট আসতে। তবে প্রচুর নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে, সব ধাপগুলো একবারে করার সুযোগ না থাকায় অনেকসময়  ৪৮-৭২ ঘন্টাও লাগতে পারে [৮]।  

কোভিড-১৯(COVID-19) ঠেকাতে বা করোনা ভাইরাসকে রুখতে কি কি সাবধানতা  নেওয়া   উচিৎ? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organisation) নভেল করোনা ভাইরাসের প্রকোপে উদ্ভব  হওয়া পরিস্থিতিকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারী হিসেবে ঘোষণা করেছে। ভারতেও  ধীরে ধীরে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই প্রতিবেদনটা লেখার দিন পর্যন্ত ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০। কর্ণাটক, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে মৃত্যু হয়েছে চারজনের। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করার কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু শুধুমাত্র প্রশাসন নয়, প্রত্যেক মানুষকে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবেই এই ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি রোধ করা সম্ভব।

  • হাত সর্বদা পরিচ্ছন্ন  রাখার চেষ্টা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর  সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হবে। হাতের তালু, আঙ্গুল ও কব্জি পর্যন্ত  ভাল করে সাবান দিয়ে ঘষে ধুতে হবে (অন্তত কুড়ি সেকেন্ড ধরে)।  হাতে ময়লা দেখা না গেলেও বারবার হাত ধুতে হবে। বিশেষ করে হাত ধুতে হবে অসুস্থ ব্যক্তির পরিচর্যার পর, হাঁচি বা কাশির পর, খাবার রান্না করার আগে,  খাবার পরিবেশন করার আগে, বাথরুম ব্যবহারের পর এবং পশুপাখির পরিচর্যার পর।
  • হাত পরিষ্কার করার জন্য যে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে, তাতে অ্যালকোহলের পরিমাণ ৭০% থেকে ৯৫% হওয়া প্রয়োজন।
  • হাঁচি-কাশি হলে, নাক দিয়ে সর্দি জল পড়লে মুখে মাস্ক পরতে হবে।
  • সারাদিন যথাসম্ভব নাকে মুখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। হাত দিয়েই আমরা প্রধানত সব কাজ করি বলে সারাদিন অনেক কিছু স্পর্শ করি যার থেকে ভাইরাস হাতে লেগে যেতে পারে। তাই অপরিষ্কার হাত দিয়ে কখনো নাক–মুখ–চোখ স্পর্শ করা উচিৎনয়।
  • সর্দি-কাশি বা জ্বর হয়েছে এমন লোকজনের থেকে অন্তত এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কারণ আর সব ফ্লুর মতোই এই রোগও সর্দি-কাশির ড্রপলেট বা কণার মাধ্যমে অন্যকে সংক্রমিত করে। এছাড়া ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছে এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ-ও  এড়িয়ে চলতে হবে। অসুস্থ পশুপাখির থেকে দূরে থাকতে হবে।
  • রুমাল বা টিস্যু পেপার হাতে না থাকলে,  মুখে হাত চাপা দিয়ে হাঁচা বা  কাশা উচিৎ নয় কারণ সেই হাতে অন্য কিছু স্পর্শ করার সম্ভাবনা থাকে। পরিবর্তে কনুই-এর কাছে বা কাঁধের কাছে মুখ গুঁজে হাঁচলে বা কাশলে সেই সম্ভাবনা কম।
  • হাঁচি বা কাশির সময়, টিস্যু পেপার ব্যবহার করার পর ওই টিস্যু পেপার যেখানে সেখানে না ফেলে, কোনও নির্দিষ্ট ঢাকনা দেওয়া ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
  • খাবার রান্নার  সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে তা সুসিদ্ধ হয়।
  • ভিড় থেকে দূরে থাকতে হবে।  যে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে লোকজমায়েত বন্ধ রাখতে হবে। সম্ভব হলে বাড়ি থেকেই অফিসের কাজ করতে হবে।একেই সামাজিক দূরত্ব  বজায় রাখা বা সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং বলে।
  • নিজেকে অসুস্থ মনে হলে ঘরে থাকতে হবে। বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। তবে বেশী অসুস্থ বোধ করলে, জ্বর হলে, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হলে দ্রুত নিকটস্থ ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তিনি বিষয়টি  খতিয়ে দেখে প্রয়োজন বুঝলে পরীক্ষা করাতে বলবেন। অর্থাৎ নিজের উপসর্গ সম্পর্কে নিজে সচেতন হয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেকে ঘরের বাইরে যাওয়া থেকে বিরত রাখতেহবে ও বাড়িতেও অন্য সদস্যদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে (সেল্ফ আইসোলেশান) বা ডাক্তারের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে হবে (সেল্ফ রিপোর্টিং)
  • জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বিদেশভ্রমণ থেকে বিরত থাকতে হবে।  অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণের ক্ষেত্রে জরুরি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
  • কেউ কোন কারণে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শ এসেছে জানতে পারলে, তার কোন উপসর্গ না থাকলেও তাকে ১৪ দিনের জন্য অন্যদের থেকে আলাদা থাকতে হবে। একেই বলে সেল্ফ কোয়ারান্টিন।
  • কারোকে অভ্যর্থনা করার সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।কারও সঙ্গে হাত মেলানো (হ্যান্ড শেক) বা কোলাকুলি না করে নমস্কার করে অভিবাদন জানাতে হবে।

সার্স কভ-২  কোনো পৃষ্ঠতলে (surface) বা কোনো জিনিসের উপর কতক্ষণ বাঁচতে পারে?

কোভিড-১৯ (COVID-19) একটা সংক্রামক রোগ। এটি মানুষ থেকে মানুষে ড্রপলেট ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে ছড়ায়। অর্থাৎ, কোনো আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ জলের ফোঁটা বা এরোসল তৈরী হয় তার মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। সেইজন্য এই  নভেল করোনা ভাইরাস কোনো জিনিসের পৃষ্ঠতলে ঠিক কতক্ষণ বাঁচতে পারে সেইটা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ-এর একদল বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এই ভাইরাসটা এরোসলে অর্থাৎ বাতাসে সূক্ষ্ম ড্রপলেট অবস্থায় প্রায় ৩ ঘন্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কার্ডবোর্ড-এর উপর ভাইরাসটা প্রায় ২৪ ঘন্টা এবং প্লাষ্টিক বা স্টেইনলেস স্টিল এর উপর প্রায় তিন দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সক্ষম [৯]।

কেন সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া জরুরি?

আগেই বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে প্রধানত তিনটে উপাদানে গঠিত এই  নভেল করোনাভাইরাস। সবচেয়ে বাইরের অংশে থাকে গ্লাইকোপ্রোটিনের কাঁটা যেগুলোর সাহায্যে ভাইরাসটা জীবন্ত কোষে আটকে গিয়ে সংক্রামিত হয়। দ্বিতীয় উপাদানটা হ’ল রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা আরএনএ (RNA)। যখন কোনও জীবন্ত কোষের ভিতরে  ভাইরাসটি ঢোকে, তখন সে বংশ বিস্তার করে আরএনএ-র  প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যম। আর তৃতীয় উপাদানটা হ’ল একটা লিপিড স্তর, এটা  ভাইরাসের অন্যান্য অংশ-কে ধরে রাখে। এই লিপিড স্তরটাকে  ভাঙ্গতে পারলে ভাইরাসটাকে মারা সম্ভব।


ছবি ৫ – সাবানের অণুর একটা মাথা, একটা লেজ (ছবির সূত্র)

সাবানের আণবিক গঠন দেখলে বোঝা যায় যে, এদের একটা মাথা এবং একটা লেজ আছে।

সাধারণত মাথাটা হাইড্রোফিলিক (hydrophilic), অর্থাৎ মাথাটার জলের অণুগুলোর প্রতি আকর্ষণ প্রবল। লেজটা আবার হাইড্রোফোবিক (hydrophobic), অর্থাৎ লেজটা জলকে একেবারেই পছন্দ করে না। এবার সাবান আর জল দিয়ে হাত ধুলে ভাইরাসের  লিপিড স্তরের প্রতি জলে গোলা সাবানের অণুর লেজের আকর্ষণ প্রবল হয়। অন্য দিকে  জলের অণু আবার সাবানের অণুর মাথাকে আকর্ষণ করে। এই টানাপড়েনের মধ্যে পড়ে ভাইরাসের লিপিড স্তরটা ভেঙে যায়, ফলে ভাইরাসটা  নিষ্ক্রিয় হয়ে মারা যায়।

ছবি ৬ –  সাবান কিভাবে ভাইরাস-কে বিনষ্ট করে (ছবির সূত্রঃ ডিপার্টমেন্ট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি,গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া-র  ফেসবুক পেজ)।

কেন হ্যান্ড সানিটাইজারের থেকে সাবান বেশি কার্যকরী?

স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হল অ্যালকোহল। অ্যালকোহল-ও করোনভাইরাস-এর লিপিড স্তরটা ভেঙে ফেলতে সক্ষম। কিন্তু সাবানের মতো ভাইরাসের লিপিড স্তরের সঙ্গে অ্যালকোহলের দ্রুত বন্ধন গঠন হয় না, যার ফলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করলে ভাইরাস নিষ্ক্রিয় হতে সময় লাগে।  তাই  হ্যান্ড স্যানিটাইজারের থেকে সাবান ভাইরাস নষ্ট করতে বেশি কার্যকরী। সাবান ও জল  ব্যবহারের সুযোগ না থাকলে তখন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিকল্প হতে পারে।

ছবি ৭ – অযথা স্যানিটাইজার ধাওয়া করা উচিত না (ছবির সূত্রঃ ডিপার্টমেন্ট অফ সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি,গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া-র  ফেসবুক পেজ।

করোনা ভাইরাস কতরকমভাবে  ছড়িয়ে পড়তে পারে? 

কোন দেশে এই ভাইরাসটার সংক্রমণ ঘটার সময় প্রধানত চারটে পর্যায়ে ভাইরাসটা ছড়ায়।

পর্যায় .বিদেশ থেকে আগত রোগীর মাধ্যমে(Imported Cases) – যে সমস্ত দেশে আগেই সংক্রমণ ঘটেছে সেই অঞ্চল থেকে কেউ সংক্রমণের শিকার হয়ে নিজের দেশে ফিরলে, তাকে প্রথম পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। 

পর্যায় আঞ্চলিক সংক্রমণ (Local Transmission) –  বিদেশ থেকে আগত রোগীর সান্নিধ্যে এসে কেউ নিজে সংক্রামিত হলে তাকে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ বলা হয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, একজন আক্রান্ত ব্যক্তির থেকে অন্য সুস্থ মানুষের সংক্রমণের সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে আনা, যাতে সংক্রমণের শৃঙ্খলটাকে (transmission chain) কেটে দেওয়া যায়। ভারতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখন এই পর্যায়ে আছে এবং সকলে সামাজিক দূরত্ব (social distance) বজায় রাখলে তবেই সংক্রমণ  এইপর্যায়ে রোখা যাবে

 পর্যায় –  পারস্পরিক সম্প্রদায়ের মধ্যেসংক্রমণ (Community Transmission) – বিদেশ থেকে আগত রোগীর বা যেকোন করোনা আক্রান্ত রোগীর সান্নিধ্যে না এসেও কেউ যখন  সংক্রামিত হয় তখন তাকে তৃতীয় পর্যায়ের সংক্রমণ  বলা হয়। এই পর্যায়ের সংক্রমণ অনেক দ্রুত, অনেক বড় এলাকা জুড়ে হয়।

পর্যায় – মহামারী (Epidemic) –  এটা শেষএবং সবথেকে খারাপ পর্যায় যখন সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুত মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এই পর্যায়ের সংক্রমণ একবার হয়ে গেলে কবে, কিভাবে আটকানো যাবে, তা বলা অসম্ভব।

শিশুদেরও কি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা আছে? 

শিশু তথা কিশোরদের কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম। CDC(Center for Disease Control and Prevention), China থেকে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে  ০-৯ বছরের শিশু এবং ১০-১৯  বছর বয়েসীদের আক্রান্তের সংখ্যা  যথাক্রমে  ০.৯% এবং ১.২% মাত্র [১০]। আরেকটা সমীক্ষা অনুসারে, কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে ০-১৪ বছরের বাচ্চাদের সংখ্যা ০.৯% যেখানে বড়দের (১৫-৪৯বছর)  সংখ্যা ৫৭.৮% [১১]। কিন্তু কেবলমাত্র কোভিড-১৯ আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে প্রকাশিত আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণাপত্রের ফলাফল অনুসারে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ছোট (<৫ বছর), বিশেষত নবজাতকদের মধ্যে শারীরিক আবস্থার সংকটজনক অবনতি হবার প্রবণতা কিছুটা বেশী [১২]।  তাই শিশুদের ক্ষেত্রেও সমস্তরকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি।

তাপমাত্রা বাড়লে ভাইরাসের প্রকোপ কমবে বলে শোনা যাচ্ছে – এটা কতটা ভরসাযোগ্য?

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির  ডঃ মেরু শীল জানাচ্ছেন, এরকম কোনো পরিষ্কার সম্ভাবনা এখনো দেখা যায়নি যাতে করে এটা বলা যায় যে পারিপার্শ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে করোনা ভাইরাসের বাড়বাড়ন্ত কমে। বিজ্ঞানীদের হাতে এখনও এব্যাপারে যথেষ্ট তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বা WHO-এর মতেও এই ভাইরাস উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু যুক্ত অঞ্চলেও ছড়াতে পারে [১৩]।

ছবি ৮ –  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞপ্তি – করোনা ভাইরাস উষ্ণ জলবায়ু কিংবা উচ্চ আর্দ্রতার মধ্যেও ছড়াতে পারে (ছবির সূত্র)

প্রচ্ছদের ছবি: এই স্ক্যানিং টানেলিং মাইক্রোস্কোপি থেকে পাওয়া ছবিটাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা রোগীর থেকে পাওয়া কোষের ওপর ভাইরাসটাকে দেখা যাচ্ছে। কোষগুলো নীল গোলাপিতে আর ভাইরাস হলুদে। (ছবির সূত্র, কৃতজ্ঞতা স্বীকার: NIAID-RML)

লেখাটির জন্য তথ্য ও আলোচনার মাধ্যমে সহযোগিতা করেছেন সোমনাথ বক্সী (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়), সৌমেন মান্না (সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স), সায়ন্তন ব্যানার্জী (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা), আবীর দাস (আই.আই.টি. খড়গপুর) এবং কুণাল চক্রবর্ত্তী (এন.সি.বি.এস.)। ‘বিজ্ঞান’ সম্পাদকমন্ডলীর অন্য সদস্যদের সাহায্য নিয়ে লেখাটি সম্পাদনা করেছে স্বাগতা ঘোষ, বনানী মন্ডল, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়  ও রাজীবুল ইসলাম।


Comments

Popular posts from this blog

বিষাক্ত শুঁয়োপোকা

দারুণ সুখবর ফ্রেশারদের জন্য ! প্রচুর পদে নিয়োগ ! জেনে নিন বিস্তারিত